কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দেশের প্রাণিসম্পদের সক্ষমতা। একই সঙ্গে বেড়েছে দুধের উৎপাদন, গত ১২ বছরে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। তবে প্রাণিসম্পদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অন্যতম অনুসঙ্গ সুষম খাদ্য। সম্প্রতি পশুখাদ্যের অপ্রতুলতার বিষয়টি সামনে আসায় প্রাণিসম্পদের সক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, একই সঙ্গে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খাদ্য গাভির দুধ উৎপাদন ও গুণগতমানের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। খাবার বেশি দিলে বেশি দুধ পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই সুষম খাদ্য হতে হবে। খাদ্যে বিদ্যমান উপাদানগুলো ভিন্ন অবস্থায় দুধের মাধ্যমে নিঃসৃত হয়। খাদ্য দুধে মাখনের উপস্থিতি কম-বেশি করতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত দানাদার খাদ্য, পিলেটজাতীয় খাদ্য, অতিরিক্ত রসালো খাদ্য, মিহিভাবে গুঁড়া করা খড়ে গাভির দুধের মাখনের হার কম হতে পারে। মাখনের পরিমাণ কমে গেলে খাদ্য পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য খাওয়াতে হয়। দুধে খনিজ পদার্থ ও খাদ্যপ্রাণের পরিমাণ গাভির খাদ্যের মাধ্যমে বাড়ানো যায়। গাভিকে সুষম খাদ্য না দিলে দুধে সামান্য মাত্রায় আমিষ ও শর্করাজাতীয় উপাদান পাওয়া যায় এবং দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়।
জানা গেছে, বর্তমানে মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলি দুধের চাহিদা রয়েছে। ১৯৭১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু দুধের প্রাপ্যতা ছিল ২৬ থেকে ২৮ মিলি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রতিদিন জনপ্রতি দুধের প্রাপ্যতা ছিল ৪৩.৪৩ মিলি। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দুধের প্রাপ্যতা বেড়ে ২০৮.৬১ মিলিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুধ উৎপাদন ২২.৮৬ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ১৩০.৭৪ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. নাথু রাম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন প্রাণিসম্পদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের খামারি, সরকার সবাই মিলে এটি করতে হবে। সরকারের প্রণোদনা লাগবে, পলিসি সাপোর্ট লাগবে। প্রাণিসম্পদের সক্ষমতা বৃদ্ধি হলে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হবে। দুগ্ধ উৎপাদনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে গোখাদ্য। সেক্ষেত্রে খাদ্যের জোগানটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মার্কেটিং- এ বিষয়গুলো বাংলাদেশে বড় চ্যালেঞ্জ এই মুহূর্তে। ঘাস কিন্তু পশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য। সরকার এটি নিয়ে ভাবছে, কিন্তু এটি আরও জোরদার করা দরকার। বিভিন্ন জায়গায় জেগে ওঠা চর কিন্তু এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। এখন কৃত্রিম প্রজনন হচ্ছে। কিন্তু কথা হলো এটি একটু সিস্টেমেটিকভাবে করতে হবে। অনেক সময় খামারিরা দেখা গেলো একটি পশুকে দিলো হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান। পরে দেখা গেলো সেটিকেই আবার শাহীওয়াল দিলো। এই যে প্রজনন পদ্ধতিটার অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু এটিকে আরও সিস্টেমেটিক ওয়েতে করতে হবে। আর প্রযুক্তি ফিডিং প্রযুক্তি, হাউজিং প্রযুক্তি, ঘাষ উৎপাদনের প্রযুক্তি হতে পারে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি হতে পারে।
এদিকে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) মাধ্যমে দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রটোকল-নীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০০টি ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৭৫টিতে কুলিং সিস্টেম দেওয়া হবে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে দুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে ন্যায্যমূল্যে দুধ বিক্রি করতে পারবেন খামারিরা। এ প্রকল্পের আওতায় খামারিদের বাড়তি দুধ উৎপাদনে প্রশিক্ষিত করা হবে। এছাড়া অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে পাঁচ বছরে দেশে দুধের উৎপাদন ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা এই প্রকল্পের লক্ষ্য।
প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তি ও কৃত্রিম প্রজনন
গাভির অধিকাংশই দেশি এবং তাদের দুধ উৎপাদন উল্লেখ্যযোগ্য নয়। তবু যতটুকু দুধ পাওয়া যায় তারা তা বাজারে বিক্রি করেন। যদিও মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক গাভি তুলনামূলকভাবে বেশি দুধ দেয় তারাও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। ফলে দেশে ক্রমশই দুধের অভাব প্রকট হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণিসম্পদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা রাখছে প্রযুক্তি। এটি ব্যবহার করে দ্রুত মাঠ পর্যায় থেকে দ্রুত রোগ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা সম্ভব। এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার করে উন্নতমানের মেশিনারিজের মাধ্যমে পশু রক্ষণাবেক্ষণ করা, উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। এতে পশু একদিকে যেমন সুস্থ থাকবে অন্যদিকে দুধ উৎপাদনও বাড়বে।
সাধারণত ষাঁড়ের বীজ সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট কয়েকটি পদ্ধতির মাধ্যমে গাভির প্রজনন অঙ্গে স্থাপন করাকে কৃত্রিম প্রজনন বলে। একটি ষাঁড়ের বীজ থেকে প্রতি বছর ৬০ থেকে ৮০টি গাভির প্রজনন করানো সম্ভব। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার গাভি প্রজনন করানো যায়। স্বাভাবিকভাবে একটি ষাঁড়ের সর্বমোট ৭০০ থেকে ৯০০টি বাছুর প্রসবে ভূমিকা রাখতে পারে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে অনেকাংশে সংক্রামক ব্যাধি রোধ করা যায় এবং গাভি ষাঁড়ের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয় না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত দুধ উৎপাদনে প্রথম। তাদের নিজস্ব কিছু জাত আছে। ভারতের ৬০-৭০ শতাংশ দুধ মহিষ থেকে আসে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব তেমন কোনো ভালো জাত নেই। যেসব জাত আছে গ্লোবালি গ্রহণযোগ্য নয় সেভাবে। ফলে সেগুলো বিশ্বমানের না হওয়ায় সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। ভালো জাতের গাভি না হলে বেশি দুধ পাওয়া যাবে না। ১৯৭৩ সালে দেশে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরু হয়। এখন শংকর জাতের অনেক গরু দেশে দেখা যাচ্ছে। ভালো মানের গাভিগুলো প্রকাশ্যে আসে না। রাতারাতি জাত উন্নয়ন হবে বিষয়টি এমন নয়।
উন্নত জাতের ঘাস উৎপাদন জোরদার
পশুপালন আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এতে গবাদিপশুর সংখ্যা বাড়লেও তাদের খাদ্যের উৎস বাড়েনি। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময় খাদ্যের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে সমস্যায় পড়তে হয় খামারিদের। এতে সুষম খাদ্যের সংকটে দুধ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এমন সমস্যার সমাধানে সীমিত জমিতে অধিক গোখাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উন্নত জাতের ঘাস চাষের দিকে বাড়তি নজর দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইইউবিএটি কৃষি পরামর্শ কার্যক্রম থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে নেপিয়ার, এন্ড্রোপোগন, স্প্লেনডিডা, রোজা, সিগনাল, জাম্বু, পারা ইত্যাদি ঘাস সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে আবাদ করা হয়। এসব ঘাসের কোনোটি একই ঋতুতে আবার কোনোটি বিভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন আবহাওয়ায় ভিন্ন চাষ পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়। বছরের যেকোনো সময়ে নেপিয়ার ঘাস আবাদ করা যায়; তবে বসন্তকালে (ফাল্গুন-চৈত্র মাসে) নেপিয়ার ঘাস আবাদ করলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। জলাবদ্ধ স্থান ছাড়া বাংলাদেশের সব ধরনের জমিতে এমনকি পাহাড়ি ঢাল এবং সমুদ্র তীরবর্তী লোনা জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ করা যায়।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস উৎপাদনের খরচ বাজার থেকে গোখাদ্য কেনার খরচের চেয়ে কম। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ঘাষ পুষ্টিগুণসম্পন্ন। একটি দুধের গাভিকে এই ঘাস খাওয়ালে তার দুধ দেওয়ার পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ে। দৈনিক খাবার খরচও কমে যায়। তবে দেশের অধিকাংশ কৃষক উন্নত জাতের ঘাস সম্পর্কে অবগত নন। এ ঘাসের চাষপদ্ধতি ও গুণাগুণ সম্পর্কে তারা অবগত হলে আরও উৎসাহিত হবেন।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের প্রধান ফসল হলো বোরো ধান, এতে উৎপাদন বেশি হয়। গবেষণা করে ধানের শীষ বড় হওয়ায় ঢাল শক্ত করা হয়েছে, এতে খড় মোটা হয়েছে। ফলে পশু অতোটা খেতে পারে না। অন্যদিকে ঘাস চাষ করতেও জমি দরকার। জনসংখ্যা বাড়ছে, রাস্তা ও বাড়িঘরে জমি ব্যবহার হচ্ছে। সেজন্য পৃথক জমিতে চাষের উদ্যোগও নিয়েছি। কিন্তু সেটি যদি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় তাহলেই মানুষ গ্রহণ করবে। সেজন্য রাস্তা, রেললাইন, পুকুর পাড়সহ যেখানে যতোটুকু জায়গা আছে ঘাস লাগানো হচ্ছে। দানাদার খাবারের মধ্যে খই, ভুসি, ভুট্টাসহ কিছু খাবার রয়েছে। সেক্ষেত্রে দানাদারের দামটাই বেশি। পশুখাদ্য বলতে এখন বাজারে দামি খাদ্যটাই বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আমরা বলি দানাদার এই খাবার পশুর জন্য খুব বেশি লাগে না। পশুকে যদি ঘাস বা খড় না দেওয়া হয় তাহলে সে ভালো প্রোডাকশন দেবে না। এজন্য আমাদের অন্যতম টার্গেট সবুজ ঘাস। যার গরু আছে তাকেই ঘাস চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছি। তাই আমরা বাজারে সবুজ ঘাস নিশ্চিতে কাজ করছি। তবে জমিতে ধান বছরে তিনবার করতে পারলেও ঘাস বছরে ছয় থেকে আটবার কাটা যায়। এতে ধানের তুলনায় ঘাসেই বেশি লাভ হয়।
তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি কিছু উদ্যোক্তা তৈরি করতে। এক ধরনের উদ্যোক্তা মার্কেট ওরিয়েন্টেড ফিড প্রোডাকশন করবে। চর এলাকাগুলোয়ও অনেক জায়গায় ঘাস চাষ হচ্ছে। অনেকে চরে নিয়ে গাভি পালন করে দুধ উৎপাদন করছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়াতে। কোস্টাল এড়িয়ায় এটি করায় কিছু সমস্যা আছে। নতুন জেগে ওঠা চর ২৫ বছর বন বিভাগের আওতায় থাকে। তারা বনায়ন করবে, এরপর জেলা প্রশাসনের ভূমি অফিসের কাছে চলে যায়।
সাইলেজ পদ্ধতি সম্প্রসারণের তাগিদ
দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা এখন দেশের উৎপাদিত গবাদি প্রাণী থেকেই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশের চারণভূমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। দানাদার খাদ্যের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। আবার দুধ উৎপাদন বাড়াতে সুষম খাদ্যও জরুরি। এমন অবস্থায় খামারিদের প্রাণিখাদ্য বিশেষ করে ঘাস খাওয়ানোর জন্য ঘাস সংরক্ষণের প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঘাসের অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সাইলেজ। সাইলেজ আধুনিক খামারিদের কাছে খুবই পরিচিত পদ্ধতি। সাইলেজ মূলত সবুজ ঘাস সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সবুজ ঘাসের পুষ্টি উপাদান সঠিক রেখে বায়ুশূন্য অবস্থায় সবুজ ঘাসকে ভবিষ্যতের জন্য প্রক্রিয়াজাত করে রাখার প্রক্রিয়াকে সাইলেজ বলা হয়। মাটিতে পুঁতেও সাইলেজ করা যায়। এজন্য উঁচু স্থান নির্বাচন করে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গর্ত করে কয়েক ধাপে সমপরিমাণে চিটাগুড় এবং পানি মিশিয়ে ঘাস পা দিয়ে ভালোভাবে চাপ দিয়ে ‘কম্প্যাক্ট’ করতে হয়। তার ওপর পলিথিন দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাটি চাপা দিতে হবে। দানাদার খাদ্যের দাম বাড়ায় খামারিদের প্রাণিখাদ্য নিশ্চিতে সাইলেজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খান সাইলেজর স্বত্বাধিকারী মো. শামীম খান জাগো নিউজকে বলেন, ডেইরি খামারিদের জন্য সাইলেজ পদ্ধতিটির একটি অভাব ছিল, সেটি থেকেই আমরা এটি করেছি। সাইলেজ অনেক পুরোনো পদ্ধতি। ২০১৭ সালে আমি প্রথম সাইলেজের বাণিজ্যিক বাজার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এখন ভুট্টার সাইলেজটা ব্যবহার করে খামারিরা যথেষ্ট লাভবান। আমার প্রতিষ্ঠানে এই পদ্ধতির মাধ্যমে ১০ থেকে ১২ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন করি। তবে আমার এখানে লোকসান আছে, পাঁচ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান করলেও তিন বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে লোকসান গুনতে হয়েছে। সরকার এ ধরনের উদ্যোক্তাদের ভর্তুকি না দিলে এই ন্যাচারাল প্রোডাক্ট উৎপাদন সম্ভব নয়। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য কোনো ভর্তুকি না দিয়ে, সার আর তেলে ভর্তুকি দিয়ে কৃষির উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভুট্টার দানা থেকে লাভবান হতে পারছিলাম না, সেজন্য সাইলেজে উদ্যোগী হয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে ভুট্টার দানার যে দাম তার সঙ্গে সাইলেজ করে আমার লোকসান হচ্ছে। বরং ভুট্টার দানা করলে বিঘাপ্রতি ১৮ হাজার টাকা লাভ হতো। বর্তমানে ভুট্টার দানার দাম বেশি, সাইলেজের দাম কম। সাইলেজে আমার যে বিনিয়োগ সেটার কারণে আমি বেরও হয়ে যেতে পারছি না।
এ বিষয়ে ড. নাথু রাম সরকার বলেন, সাইলেজ চর্চা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। সরকার থেকে উদ্যোক্তা তৈরি করে এটি করতে হবে। সাধারণ কৃষক কিন্তু সাইলেজ করতে পারবে না। বাংলাদেশে প্রায় ছোটবড় আড়াইশ’ সাইলেজ বিষয়ক উদ্যোক্তা আছে। তার মধ্যে চার-পাঁচজন একটু বড় আকারে মার্কেটে আছে। অনেক সময় কিন্তু এখানে লোকসান হয়ই, আমাদের দেশের মানুষ তো অভ্যস্ত নয়। যারা একটু বড় খামারি তারা হয়তো অভ্যস্ত। সাইলেজ এখন ১২ থেকে সাড়ে ১২ টাকা, কেউ কেউ ১৭-১৮ টাকায়ও বিক্রি করছে। কিন্তু অনেকেই জানে না সাইলেজ জিনিসটা কি এবং এটা কতোটা উপযোগী খাবার সেটি সম্পর্কে খামারিদের অনেকেরই ধারণাই নেই।
সার্বিক বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দুধের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার। দুধের উৎপাদন বাড়াতে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণের মাধ্যমে অধিক উৎপাদনশীল ও উন্নত জাতের গবাদিপশু পালনে সরকার খামারিদের উদ্বুদ্ধ করছে। বিনামূল্যে উন্নত জাতের সিমেন সরবরাহ করা হচ্ছে খামারিদের। সহজ শর্তে সরকার তাদের ঋণ দিচ্ছে। তাছাড়া গবাদিপশুর নতুন জাত উদ্ভাবন ও বিদ্যমান জাত উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এ বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা পরিচালনা করছে। ফলে অধিক দুধ উৎপাদনে সক্ষম গবাদিপশু পালনে খামারিরা উৎসাহিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও কার্যকর উদ্যোগের কারণে গত ১২ বছরে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। দেশে দুধের উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে এ খাতে এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প তথা প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প সরকার বাস্তবায়ন করছে। দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ অত্যন্ত প্রয়োজন। এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে সরকার নীতি সহায়তার পাশাপাশি কর রেয়াতসহ নানা সুবিধা অব্যাহত রেখেছে। সমন্বিত এসব উদ্যোগের কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা মাংস ও ডিমের পাশাপাশি দুধেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবো বলে আশা করছি।