রাজধানীর মহাখালীতে তিন দশক আগে একটি জুতার কারখানায় চাকরি করতেন বগুড়ার আবদুল করিম দুলাল। দুই সহকর্মীর সঙ্গে থাকতেন কোম্পানির মেসে। এলাকার দূরসম্পর্কের আত্মীয় নজরুল ইসলাম দুদু মিয়া এক দিন এসে ওঠেন দুলালের মেসে। দুদুকে আশ্রয় দেওয়াই কাল হয় দুলালের জীবনে।
সেটি ১৯৯৩ সালের ২৪ মের কথা। দুদু একটি ব্যাগ দুলালের কাছে রেখে বেরিয়ে যান। পরদিন সিআইডি পুলিশ দুলালের মেসে তল্লাশি চালিয়ে ওই ব্যাগ থেকে তিনটি দামি মূর্তি উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার হন দুলাল ও দুদু। গুলশান থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে তাঁদের দু’জনের বিরুদ্ধে। সেই শুরু তাঁর আদালতের বারান্দায় দৌড়ঝাঁপ। এর পর ৩০ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি সেই মামলা।
তরুণ বয়সে আসামি করা হয়েছিল দুলালকে। এখন তাঁর বয়স ৫৫ বছর। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকেন বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়া ইউনিয়নের ধাওয়া পিকসন গ্রামে। এখন অনেকটা অসুস্থ তিনি।
ওই মামলায় হাজিরা দিতে সর্বশেষ গত ৪ জুন বগুড়া থেকে ঢাকায় এসেছিলেন দুলাল। এ মামলায় তিনি ১ নম্বর আসামি। সেদিন ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ছুটিতে থাকায় মামলার শুনানি হয়নি। পরবর্তী তারিখ রাখা হয়েছে আগামী ৬ জুলাই।
এভাবে দেড়-দুই মাস পরপর মামলায় হাজিরা দিতে বগুড়া থেকে ঢাকায় আসতে হয় দরিদ্র দুলালকে। মামলার ২ নম্বর আসামি দুদু মিয়া প্যারালাইজড হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২০১৯ সালে মারা গেছেন। স্বাধীনতার পর স্থানীয় জাসদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন দুদু।
দুদু মরে বেঁচে গেছেন। আর দুলাল জানেন না, কবে শেষ হবে তাঁর এই ভোগান্তি। কত দিন আদালতে ঘুরতে হবে তাঁকে। বর্তমানে বগুড়া শহরে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করছেন তিনি।
পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্য
মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, ডায়মন্ড শু ইন্ডাস্ট্রিজের ভেতরে ছোট একটি কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে দুলালের দখল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তিগুলো উদ্ধার করা হয়। মামলার ২ নম্বর আসামি দুদু মিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তিগুলো বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বগুড়া থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তিনি এগুলো দুলালের কাছে রেখে ক্রেতা ঠিক করার জন্য গুলশান দূতাবাস এলাকায় যান। পরদিন দুদু মিয়া ক্রেতা ঠিক করে। মূর্তিগুলো আনার জন্য সেখানে গেলে স্থানীয় লোকজন তাঁকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, তল্লাশি চালিয়ে পিতল, পাথর ও কষ্টিপাথরের তিনটি মূর্তি উদ্ধার করে সিআইডি পুলিশ।
আরো জানা গেছে, উদ্ধারকৃত মূর্তিগুলো পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়নি এবং তা আদালতেও প্রদর্শন করা হয়নি। এমনকি আদালতে আলামতও শনাক্ত হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলামত প্রদর্শিত না হলে মামলার কোনো গুরুত্ব থাকে না।
১৯৯৪ সালে এ মামলার বিচার শুরু হয়। এতে ১০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫ জন সিআইডি কর্মকর্তা, একজন ম্যাজিস্ট্রেট; বাকি চারজন শু ফ্যাক্টরির কর্মচারী। সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোনো সাক্ষী আদালতের জবানবন্দিতে বলেননি, ১ নম্বর আসামি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। মূল আসামি মারা যাওয়ায় মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর বক্তব্যে পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া এক সাক্ষীর সঙ্গে অপর সাক্ষীর বক্তব্যের কোনো মিল নেই।
অভিযোগ রয়েছে, আসামিদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করে পুলিশ। আসামিদের কাছ থেকে যে ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেন, তিনিও মামলায় সাক্ষ্য দেননি। মামলার বাদীও সাক্ষ্য দেননি। ফলে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বলে আসামিপক্ষের লিখিত যুক্তিতর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২৫ বছরে মামলার কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষী না আসার দায় পুলিশের।
জানা গেছে, এ মামলায় বাদীর (সিআইডির পরিদর্শক শহীদুল হক) হালনাগাদ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনিসহ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাক্ষীরা বেঁচে আছেন কিনা, কারও জানা নেই। তবে অধিকাংশ সাক্ষী সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় অনেক আগেই অবসরে গেছেন। দুলালের আইনজীবী মাহবুবুল আলম সমকালকে জানান, সাক্ষীদের বক্তব্যে দুলাল দোষী থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। দুলালের বিরুদ্ধে যে আইনে মামলা করা হয়েছে, তার সর্বোচ্চ সাজা তিন মাসের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে। তিনি আরও জানান, মানবিক কারণে দুলালের কাছ থেকে মামলার কোনো ফিস নিচ্ছেন না। কারণ, দুলাল গরিব ও অসুস্থ।
চোখের পানি মুছতে মুছতে দুলাল বলেন, ‘দুদুর কারণে আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। তাকে মেসে আশ্রয় দিয়ে আমি ফকির হয়ে গেছি। এই বিপদ থেকে মুক্তি চাই আমি।’