রবিবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪
spot_img
Homeখেলাধুলাকৃষক বাবার চ্যাম্পিয়ন কন্যা কৃষ্ণা রানীর অপেক্ষায় স্বজনেরা

কৃষক বাবার চ্যাম্পিয়ন কন্যা কৃষ্ণা রানীর অপেক্ষায় স্বজনেরা

টাঙ্গাইলের গোপালপুরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাথালিয়ার কৃষক বাবার কন্যা কৃষ্ণা রাণী সরকার। গত সোমবার নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলার অদম্য মেয়েরা। সাবিনা-সানজিদাদের ওই দলের সাবেক অধিনায়ক কৃষ্ণা রাণী সরকারের জোড়া গোলে বাংলাদেশকে একটি অর্জন এনে দিয়েছে। অদম্য সেই কৃষ্ণার অপেক্ষায় রয়েছে বাবা-মা, স্বজন ও গ্রামবাসীরা। কখন আসবে ফুটবল কন্যা কৃষ্ণা তার গ্রামের বাড়িতে। কৃষ্ণার এই সাফল্য অর্জনে আসন্ন দূর্গোৎসবে আরো আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে তার পরিবারের মাঝে।

মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে কৃষ্ণাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের মানুষজন কৃষ্ণাদের বাড়িতে আসছে খুশির খবর দিতে এবং নিতে। তার বাবা বসুদেব সরকার ও মা নমিতা রানী ব্যস্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে। এছাড়া সাংবাদিকরাও বাড়িতে হাজির হচ্ছেন।

জানা গেছে, কৃষ্ণা রাণী সরকার অনুর্ধ্ব-১৬ মহিলা দলের অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। তার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক গল্প-কাহিনী। গরীব কৃষক পরিবারের ঘরে জন্ম গ্রহণ ও বেড়ে ওঠা তার এমন সাফল্য সত্যিই সকলের কাছে প্রশংসনীয়। এক সময় যারা সামাজিক কুসংস্কার তুলে মেয়েদের ফুটবল খেলা অপছন্দ করতেন তারাই এখন কৃষ্ণার সাফল্য দেখে গর্ব করছেন।

গোপালপুরের পাথালিয়া গ্রামের অনেকেই বলেন, কৃষ্ণা শুধু গ্রামের নারী ফুটবলার নয়, সে সারাদেশের ফুটবলার। দেশের গৌরব। এই গৌরবে গৌরবান্বিত গ্রামের মানুষ। খেলার দিন এলাকায় বিদ্যুত না থাকায় অন্য এলাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে খেলা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তার জোড়া গোল এবং খেলা খুবই ভাল লেগেছে। নেট দুনিয়ায় তার খেলার কিছু খন্ডচিত্র ভাইরাল হয়েছে। টেলিভিশন খুললেই কৃষ্ণা ও তার দলের ফুটবলার নারী খেলোয়ারদের দেখা যায়।

কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার

কৃষ্ণার কাকা নিতাই সরকার বলেন, কৃষ্ণাকে ছোট থেকেই উৎসাহ দিয়েছি। সংসারে অভাব ছিল তারপরও ওর খেলা বন্ধ করিনি। স্থানীয় বাপন স্যারের মাধ্যমে কৃষ্ণা বিনামূল্যে পড়াশুনা ও খেলাধুলা করার সুযোগ পায়। প্রথমে স্কুল ভিত্তিক, পরে ইউনিয়ন। এরপর উপজেলা-জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায় সে। এভাবেই সে তার লক্ষে পৌছে গেছে। পাশাপাশি পড়াশুনা চালিয়ে গেছে। আজ সে দেশের সুনাম অর্জন করেছে এতে আমরা স্বজনরা যেমন আনন্দে উচ্ছাসিত গ্রামের মানুষজনও অনেক খুশি।

কৃষ্ণার খেলার সহপাঠী সামিরা আখতার পলি বলেন, কৃষ্ণার খেলা দেখে আমিও তার সাথে ফুটবল খেলতে শুরু করি। প্রথমে ইউনিয়ন পরে উপজেলা- জেলা পর্যায়ে খেলায় অংশ গ্রহণ করেছি। পরে সামাজিক কুসংস্কার ও পারিবারিক চাপের কারণে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে কৃষ্ণা হাল ছাড়েনি। শত বাধা অতিক্রম করে সে এখন বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে দেশের সুনাম অর্জন করেছে। আর আমি বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর সংসার করছি। তখন ইচ্ছে থাকার পরও খেলতে পারিনি নইলে আমিও কৃষ্ণার মত বড় খেলোয়ার হতে পারতাম। আজ কৃষ্ণাকে নিয়ে দেশের মানুষ গর্ব করছে। আমার ছোট বেলার খেলার সাথী সে আরো এগিয়ে যাক এবং এমন জয়ের ধারা অব্যাহত রাখুক এই কামনা করি।

কৃষ্ণার মা নমিতা রাণী সরকার

কৃষ্ণার মা নমিতা রাণী সরকার বলেন, আমার এক মেয়ে এক ছেলে। কৃষ্ণাই বড়। যখন কৃষ্ণা ফুটবল খেলতো এলাকায় তখন মানুষজন এটাকে ভালভাবে নেয়নি। মেয়ে মানুষ কেন ফুটবল খেলবে এটা ঠিক না। মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে এমন ধরনের অনেক কথাই বলতো। কিন্তু তারাই এখন কৃষ্ণার সাফল্যের কথা বলছে। তারাও এখন গর্ববোধ করে গ্রামের মেয়ে কৃষ্ণা এখন দেশ সেরা খেলোয়ার। মেয়েটি বিদেশে খেলায় অংশগ্রহণের জন্য যাওয়ার পর আর তার সাথে কথা হয়নি। এখনও কথা হয় হচ্ছে। তবে আমার ছেলের সাথে নিয়মিত কথা হয় কৃষ্ণার। তার আসার অপেক্ষার দিনগুনছি।

কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার বলেন, যেদিন খেলা শুরু হয় তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। বাড়ি থেকে দুই মাইল দুরে গিয়ে জেনারেটরের মাধ্যমে খেলা দেখি। পরে অনেক মানুষের মধ্যে মেয়ের খেলা উপভোগ করেছি। এতে খুবই আনন্দ লেগেছে। মানুষজনও আমাকে অনেক অভিনন্দন জানিয়েছে। অনেকেই তখন বলছে কৃষ্ণার বাবার সাথে বসে আমরা খেলা দেখছি। মেয়েটার সাথে অনেকদিন হল কথা বলতে পারছি। বড় মোবাইল (এন্ড্রয়েট) না থাকাতে তাকে যেমন দেখতেও পারছি না তেমনি কথাও বলতে পারছি না। কবে এখন তার আসার অপেক্ষায় আছি। কখন এসে বলবে বাবা আমি দেশ সেরা হয়ে বিজয় অর্জন করেছি।

কৃষ্ণার স্কুল কোচ গোলাম রায়হান বাপন বলেন, কৃষ্ণার হাত ধরেই এই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন হয়েছে। কৃষ্ণা খুবই দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে। আজ সে দেশ সেরা নারী ফুটবল খেলোয়ার। দেশের সুনাম অর্জন করেছে সে। এতে শিক্ষক হিসেবে যেমন গর্বিত তেমনি পুরো উপজেলাবাসী তথা দেশের মানুষ এই আনন্দে উচ্ছাসিত। তাকে দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উদ্ধুদ্ধ হবে। সে এই জয়ের ধারা বজায় রাখবে এটাই প্রত্যাশা করি।

গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুছ আলী তালুকদার ঠান্ডু বলেন, ২০০৯ সালে চেয়ারম্যান হওয়ার পরই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার আয়োজন করতাম। বাংলাদেশে প্রথম প্রাইমারী বিদ্যালয়ে ফুটবল খেলায় সারাদেশে প্রথমস্থান অর্জন করে গোপালপুর। কৃষ্ণা যখন ফুটবল কিনে দেই তখন তাদের গ্রামের বাড়ি পাথালিয়া এলাকায় মাঠে খেলা হত। তখন অনেকেই বলতো উপজেলা চেয়ারম্যান কেন মেয়েদের ফুটবল খেলাধুলা করায়। তারপরও কৃষ্ণা খেলাধুলা সামগ্রী কিনে দিয়েছি। এরপর টিম দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। আমার আনন্দ একটাই যে কৃষ্ণা এখন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশের সুনাম বা অর্জন দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

পর্যালোচনা সংক্ষিপ্ত বিবরণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন