বিশাল আকৃতির বাগাড় মাছ। আছে বোয়াল, চিতল, বিপন্ন মহাশোল, রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউশসহ বড় আকারের নানান মাছ। রয়েছে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের সমারোহ। হাওর-নদীর তরতাজা মাছে চারদিক সয়লাব। এ যেন মাছেরই রাজ্য। ধুম পড়েছে মাছ কেনাবেচার।
পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুরে দুই দিনব্যাপী মাছের মেলা বসেছে। তিন একর এলাকাজুড়ে বসেছে ৩০০টিরও বেশি মাছের দোকান। এসব দোকানে একদিনেই বিক্রি হয় তিন কোটি টাকার মাছ।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, ১৩ জানুয়ারি রাত থেকে ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে পাইকারি দামে মাছ বিক্রির এই হাট। এখানে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ও ব্যবসায়ীরা খুচরা বাজারে বিক্রির জন্য মাছ নিয়ে আসেন।
মেলা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আড়তদাররা মাছ নিয়ে এসেছেন। মজুত করে রাখা হয়েছে ছোট-বড় নানা জাতের মাছ। আছে বাগাড়, বোয়াল, আইড়, চিতল, কাতলা, রুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এছাড়া নানা ধরনের গৃহস্থালি ও বিভিন্ন ধরনের আসবাব, সৌখিন জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা নিয়ে বসেছে অসংখ্য দোকান। অন্যদিকে কাঠের তৈরি খাট, আলমারি, আলনাসহ নানা আসবাবপত্র নিয়েও বসেছেন কয়েকজন দোকানি।
স্থানীয়রা জানান, পৌষ সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দুই দিনব্যাপী এই মেলার আয়োজন করা হয়। মাছ কেনাবেচার গ্রামীণ এ উৎসবের নাম ‘মাছের মেলা’। এ মেলাটি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতা, আয়োজক ও দর্শনার্থীদের আনন্দ উৎসবের অন্যতম খোরাক। যেখানে লাখ টাকা দাম হাঁকা হয় বিশাল আকৃতির একেকটি মাছের। চলে কোটি টাকার কেনাবেচা।
জানা যায়, পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে মাছের মেলার প্রচলন শুরু করেন জমিদার মথুর বাবু। শুরুতে মেলাটি সদর উপজেলার মনুমুখ এলাকায় হলেও পরবর্তীতে উপজেলার শেরপুরে স্থানান্তর করা হয়। মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, হাইল হাওর এবং মনু, ধলই, কুশিয়ারা নদীসহ বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন হাওরের মাছের ওপর নির্ভর করে প্রতি বছরই বসে এ মেলা। মৎসজীবীরা এ মেলায় মাছ বিক্রির জন্য ৫ থেকে ৬ মাস আগে থেকেই বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেসব মাছ বিশেষ ব্যবস্থায় পানিতেই বাঁচিয়ে তাজা রাখা হয়।
মাছ ব্যবসায়ী শামীম মিয়া বলেন, বাজার জমেছে। আশা রাখি ভালো বেচাকেনা হবে। ১০ লাখ টাকার মাছ মজুত করেছি। এখন পর্যন্ত তিন লাখ টাকার বিক্রি করেছি।
আরেক মাছ ব্যবসায়ী নাজমুল মিয়া বলেন, গত দুই বছর মাছের মেলা বন্ধ ছিল। এবার জমে উঠেছে। নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ এসেছে।
শাহজালাল মৎস্য আড়তের মালিক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, আমার আড়তে মেঘনা নদী থেকে ধরা ৮০ কেজি ওজনের বাগাড় এসেছে। ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দাম হয়েছে।
শেরপুর আড়তের ঠিকাদার তপু ভৌমিক বলেন, প্রতি বছর এখানে নিলামের মাধ্যমে মাছের আড়ত পরিচালনা করা হয়। এ বছর মাছের সংখ্যা বেশি। ধারণা করছি এবার কমপক্ষে ৬ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হবে। মাছের মেলা ছাড়াও শেরপুরে বড় ২০টি আড়ত রয়েছে। মূলত স্থানীয় কুশিয়ারা নদী, হাকালুকি হাওর, কাউয়া দিঘি হাওরের মাছ এ মেলায় বেশি দেখা যায়। এ ছাড়াও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর হাওর, নীলাদ্রি লেইক এবং দেশের বিভিন্ন স্থানের মাছের আগমন ঘটে এই মেলায়।
মাছের মেলা কমিটির সাবেক সভাপতি অলিউর রহমান বলেন, ১৩ জানুয়ারি রাত থেকে ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলার জন্য কম করে হলেও ৩-৪ লাখ টাকা ইজারা মূল্য দিতে হয়। করোনার কারণে গত বছর মাছের মেলা হয়নি। হাওর-বাঁওড়, নদী, বিল ভরাট হওয়ার কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগের মতো বড় আকৃতির মাছ না থাকলেও ঐতিহ্যবাহী এই মেলার কদর স্থানীয়দের আবেগের সঙ্গে মিশে আছে।
মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গত বর্ষায় সিলেট বিভাগে বন্যা হওয়ায় সবকটি হাওর-জলাশয়ে মাছের বিচরণ বৃদ্ধির কারণে প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন হয়েছে। গত অর্থ বছরে মৌলভীবাজারে মাছের উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৫৫২ টন। এবার এর উৎপাদন আরও বেড়েছে। আগামী জুনে এর হিসাব আসবে।