রবিবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪
spot_img
Homeরাজধানীভয়ংকর মাদক ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ ছড়িয়ে পড়ছে

ভয়ংকর মাদক ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ ছড়িয়ে পড়ছে

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বিজলী মহল্লার এ-ব্লকের বাসিন্দা মাহবুবা আক্তার। ২৭ জানুয়ারি তার বাড়ির পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্য আসেন সেলিম আহমেদ নামের একজন। ফ্ল্যাট দেখে মোটামুটি পছন্দ হয় তার। পরদিন তিনি তার স্ত্রী ও মা পরিচয়ে দুই মহিলাকে নিয়ে পুনরায় ওই বাড়িতে আসেন।তারা মাহবুবা আক্তারের ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছিলেন। একসময় মাহবুবা দুই মহিলাকে নিয়ে তার শোয়ার ঘরে যান। একে একে ওই মহিলার হাতে তুলে দেন তার নিজের পরিধেয় হাতের চুড়ি, কানের দুল, আংটিসহ প্রায় সাত ভরি স্বর্ণালংকার। কিছুক্ষণ পর তারা ওই বাসা থেকে বিদায় নেন।তাদের গেট পর্যন্ত এগিয়েও দেন মাহবুবা আক্তার। তবে কিছু সময় পর শোয়ার ঘরের আলমারি খোলা দেখে তিনি নিজেই হতকিত হন। একে একে ফিরে আসতে থাকে আগের ঘটে যাওয়া সব দৃশ্য। রীতিমতো মর্তে ফেরেন তিনি।তবে ততক্ষণে সব শেষ!

গত বছর জুন মাসে এ ধরনেরই প্রতারণার শিকার হন দনিয়া সরাই রোডের হালিমের এপি-৭৪৭ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা ডলি ইসলাম। ওই দিন রাত ১১টার দিকে কদমতলী থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন তার ছেলে নাফরুল হাসান। ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডলি ইসলাম বলেন, ‘আমি একটি দাওয়াত শেষে ধোলাইপাড় দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম।৩ নম্বর গলির মাথার মিষ্টির দোকানের সামনে পৌঁছলে একজন নারী আমার কাছে একটি রসিদ দেখিয়ে বলেন, তারা এতিমখানার জন্য সাহায্য ওঠাচ্ছেন। আমার কাছেও কিছু সাহায্য চান তিনি।অনুনয় করে আমার হাতে রসিদ বইটি তুলে দেন ওই নারী। একপর্যায়ে আমি কোনো প্রশ্নবাক্য ছাড়াই আমার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন, কানের দুল, একটি মোবাইল ফোন ও সঙ্গে নগদ ৪ হাজার টাকা থাকা ভ্যানেটি ব্যাগ তার হাতে তুলে দিই। বাসায় যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আগের প্রতিটি ঘটনা আমার চোখের সামনে ফিরে আসতে থাকে। টানা চার দিন আমি রীতিমতো ট্রমার মধ্যে ছিলাম। ’পরে কথা হয় জিডির বাদী নাফরুলের সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, থানায় যাওয়ার পর ডিউটি অফিসার রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনারাও এ ধরনের ঘটনার শিকার! কিছুক্ষণ আগেও তিনটা জিডি হয়েছে একই ধরনের ঘটনায়। ’ ওই ঘটনাগুলোর সময় কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে ছিলেন জামাল উদ্দীন মীর। বর্তমানে তিনি মুগদা থানায় কর্মরত।তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই, মোহাম্মদপুর থানা এলাকায়ও এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি প্রতারকদের শনাক্ত করতে। ’ কোনো অপরিচিত লোকের কাছ থেকে কোনো কিছু নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।ওপরের বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাদের ধারণা, এসব প্রতারণায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের শ্বাস’ নামক ড্রাগ স্কোপোলামিন (scopolamine), যেগুলো সাধারণত সত্য উদ্্ঘাটনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ব্যবহার করে থাকেন।অনুসন্ধানে জানা গেছে, শয়তানের নিঃশ্বাস নামক ওষুধের উৎপত্তি হয় কলম্বিয়ায়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ ‘সত্যের সিরাম’ অর্থাৎ সত্যের সন্ধানে এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২২ সালে এটি কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয় ‘ড. রবার্ট হাউস’ নামক একজনের সন্ধানে তথ্য বের করার ক্ষেত্রে। বর্তমানে এ মাদকটি মূলত প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে থাকে।লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে, বিশেষ করে কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি প্রভৃতি দেশে এটি মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। অপরাধীরা বিভিন্ন বয়সীদের যৌন মিলনে বাধ্য করতে এ মাদকটি ব্যবহার করে থাকে। পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরি করতে বা নগ্ন ছবি তোলার জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই ড্রাগটি তো অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে আছে। ক্লিনিকোলজিক্যাল কাজে এটি ব্যবহার করা হতো। এগুলো আগে সবার হাতের নাগালে ছিল না। তবে এখন সমাজের বখে যাওয়া কিছু লোক এই ড্রাগটিকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করছে, যা খুবই ভয়ংকর সংকেত। এই ড্রাগ অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে নষ্ট করে দেয়।এই ড্রাগটি খুবই বিষাক্ত। একে মোটিফায়েড করে নেশার জিনিসে রূপান্তর করছে কেউ কেউ। ’

জানা গেছে, গত বছর ২১ নভেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো ‘ক’ শ্রেণির মাদক ডাইমেথক্সিব্রোমো অ্যাম্ফেটামিন (ডিওবি) খুলনা থেকে জব্দ করে ডিএনসিগ্রেফতার করা হয় আসিফ আহমেদ, অর্ণব কুমার শর্মা ও একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী মামুনুর রশীদকে। ডার্ক ওয়েবসাইটে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে পোল্যান্ড থেকে ২০০ ব্লট ডিওবি অর্ডার করেন খুলনার যুবক আসিফ আহমেদ শুভ। অর্ডারের পর ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চালানটি সরাসরি তার বাসায় পৌঁছায়।।ওই ঘটনায় ঢাকার নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়। পরে এলিট ফোর্স র‌্যাব ডিওবির সন্ধান পায়। আইস ও এলএসডির পর দেশে ডিওবির বিস্তার রীতিমতো ভাবাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। তারা বলছেন, এলএসডির মতো ল্যাবরেটরিতে তৈরি এই মাদকও আসছে ইউরোপ থেকে।যেভাবে কাজ করে : এই ড্রাগ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা। মানুষ অনেকটা হিপনোটাইজের মতো হয়ে যায়। তখন মানুষ নিজের বশে কিংবা সজ্ঞানে থাকে না। অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আগে পাশ্চাত্যের দেশসমূহে এর ব্যবহার বেশি পরিলক্ষিত হলেও আজকাল পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এর ব্যবহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।নানাভাবে ও নানা কৌশলে এটি প্রয়োগ করা হয়। খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে, কাগজে মিশিয়ে পড়তে দিয়ে, পানির সঙ্গে মিশিয়ে।

স্কোপোলামিন তরল ও শুকনো দুই ফরম্যাটেই পাওয়া যায়। এই ড্রাগটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, যার প্রতিক্রিয়া থাকে ২০ থেকে ৬০ মিনিট।খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিন দিন। ড্রাগটি দেখতে হুবহু কোকেন পাউডারের মতো সাদা। এর ক্ষতির মাত্রা কোকেন থেকে বহুগুণ বেশি। স্কোপোলামিন শব্দ, তাপ, চাপ, ব্যথা ও নিউরনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। রক্তে মিশে যায় এবং নিউরোট্রান্সমিটারে প্রবেশ করে।

পর্যালোচনা সংক্ষিপ্ত বিবরণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন