২০২৩ সালে ইসরায়েল তার জন্মের ৭৫তম বার্ষিকী পালন করেছে। ২০২৮ সালে দেশটির প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পূর্ণ হবে। এরই মধ্যে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন হামলা এবং প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলের আগ্রাসন ইসরায়েলিদেরকেই ভাবিয়ে তুলেছে।
তাদের উদ্বেগের বিষয় এই যে, ইসরায়েল শেষ পর্যন্ত অভিশপ্ত ৮০ বছর পূর্ণ করতে পারবে কি না। দেশটির সাধারণ কোনো নাগরিক বা বিশেষজ্ঞরা নন, দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীরাই এমন সংশয় প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, গাজা যুদ্ধ হচ্ছে ইসরায়েলের শেষের শুরু। ইসরায়েল বলছে, তাদের আত্মরক্ষার জন্যই এই হামলা চালানো হচ্ছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হত্যাযজ্ঞে ইসরায়েলের আত্মরক্ষা তো হবেই না, বরং দেশটি আরো অনিরাপদ ও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল।
অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়: চলতি বছরের ১৪ মে ইসরায়েল তার ৭৫ বছর পূর্ণ করে। ইসরায়েলি গণমাধ্যম ‘দ্য জেরুজালেম পোস্ট’ চলতি বছরের পহেলা মে এক প্রতিবেদনে জানায়, ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে ইসরায়েল তার ৮০ বছর পূর্ণ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সৌল (হিব্রু বাইবেল অনুসারে, সৌল হচ্ছেন ইউনাইটেড কিংডম অব ইসরায়েলের প্রথম রাজা), ডেভিড (ইসলামের নবি হজরত দাউদ আ.) ও সলোমান (ইসলামের নবি হজরত সোলাইমান আ.)-এর একত্রিত রাজতন্ত্রও ১০০ বছরের বেশি টিকতে পারেনি। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০ থেকে ৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যখন পম্পেই জেরুজালেম দখল করে, তখন হাসমোনিয়ান রাজবংশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে শাসন করেছিল, যার মেয়াদ ছিল ৭৭ বছর। কোনো রাষ্ট্রই বিদেশি শত্রুদের মাধ্যমে নয়, অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্ব দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল, যা আজকের ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। ৭০ থেকে ৮০ বছর, প্লাস বা মাইনাস দুই বা তিন, সর্বজনীনভাবে তিন প্রজন্মের আয়ুষ্কাল হিসেবে বিবেচিত। তাদের ক্রম একটি নিয়মিত ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে বলে মনে করা হয়। প্রথম প্রজন্ম সৃষ্টি করে বা সম্পদ গড়ে তোলে, দ্বিতীয়টি সেই ধারা বজায় রাখে এবং তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্ম সেগুলো ধ্বংস করে।
আরব ঐতিহাসিক ইবনে-খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) অনুমান করেছেন যে সভ্যতাগুলো প্রথম রাজবংশের দ্বারা তৈরি হয়েছে, দ্বিতীয়টি রক্ষণাবেক্ষণ করেছে এবং তৃতীয়টি ধ্বংস করেছে। টমাস মানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বই বুডেনব্রুকস (১৯০১) একটি বণিক পরিবারের গল্প বলে যেটি এক প্রজন্মে সম্পদ এবং খ্যাতি অর্জন করে, দ্বিতীয় সময়ে তার সেগুলো সংরক্ষণ করে, তৃতীয় বা চতুর্থটিতে পতন ঘটে। ইহুদি ইতিহাসের নজিরগুলোর জন্য হারজগের অনুসন্ধান সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে সমান্তরাল অনুসন্ধানকে উত্সাহিত করে। বিংশ শতাব্দীতে অনেক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯২২), তুর্কি প্রজাতন্ত্র (১৯২৩), ভারতের প্রজাতন্ত্র (১৯৪৭), গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (১৯৪৯) এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র (১৯৪৮)। পাঁচটি রাষ্ট্রই প্রায় তিন প্রজন্মের পর একটি ঐতিহাসিক মোড় পৌঁছেছে। এর মধ্যে দুইটি সফল হতে পারেনি। ৬৯ বছর পর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ইউএসএসআর ভেঙে যায়। ৮০ বছর পর ২০০৩ সালে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক একটি ইসলাামি রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং সংগ্রাম চালিয়ে যায়। দুইটি রাষ্ট্র টার্নিং পয়েন্ট অতিক্রম করেছে এবং ভালে করছে। ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের ৬৭ বছর পর ভারত ২০১৪ সালে একটি প্রকৃত হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। চীন ২০২২ সালে সীমাহীন মেয়াদের জন্য তার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে পুনর্নির্বাচিত করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর চীনারা এটি করতে সক্ষম হয় ইসরায়েল তার ৭৫তম বছরে তার গভীরতম রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। এটা কি নিছকই কাকতালীয় যে বিংশ শতাব্দীতে স্থাপিত পাঁচটি ভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র সমস্যা বা রূপান্তরের দিকে গিয়েছিল? এই রাষ্ট্রগুলোর জন্মের ৬৯, ৮০, ৬৭, ৭৩ বা ৭৫ বছর পর এসব রূপান্তর ঘটেছে বা শুরু হয়েছে। এটি কি একটি অলিখিত ‘তিন-প্রজন্ম’ নীতিকে মনে করিয়ে দেয়? কারণগুলোর একটি ভিন্ন মিশ্রণ এই ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু তিনটি মানদণ্ড সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। শাসন ও নেতৃত্ব, অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ সংহতি।
সোভিয়েতরা তিনটি মানদণ্ডেই ব্যর্থ হয়েছিল। অযোগ্য নেতা এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা ছাড়াও একটি মূল কারণ ছিল অ-রুশভাষী নাগরিকদের দ্রুত জনসংখ্যাগত বৃদ্ধি যাদের মধ্যে বেশির ভাগই না হলেও অব্যাহত রাশিয়ান শাসনের প্রতি উদাসীন বা শত্রুভাবাপন্ন ছিল তারা। শেষ পর্যন্ত তারা সোভিয়েত জনসংখ্যার ৪০ বা তার বেশি শতাংশে পৌঁছেছিল। ফলে দেশটিতে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায়।
বিপরীতে ভারত তিনটি মানদণ্ডেই শক্তিশালী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শান্ত ‘হিন্দু বিপ্লব’ আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসে স্থিতিশীলতার দীর্ঘতম সময়ের একটির সূচনা করেছে এবং অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী অবস্থান দেশের মধ্যে সংহতি বৃদ্ধি করেছে। চীনে এখন এমন একজন নেতা রয়েছে, যার ক্ষমতা তার তিন পূর্বসূরির চেয়ে সীমাহীন। চীনের বৈশ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতি শিগিগরই বিশ্বের বৃহত্তম হবে। ৯৫ শতাংশ হুন সম্পদ্রায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয় ঐক্য স্থিতিশীল বলে মনে হচ্ছে। তুরস্ক একটি গুরুতর নেতৃত্ব সমস্যার বিপদ প্রদর্শন করে। ২০০৩ সালে যখন ইসলামিকীকরণ শুরু হয়েছিল অনেক তুর্কি সেটিকে প্রথম স্বাগত জানিয়েছিল। তারা ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি অভিজাতদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু যখন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অনিয়মিত ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন, তখন তিনি জাতীয় সংহতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উভয়ের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ান।
৭৫ বছরে বিপদে ইসরায়েল: নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক শক্তি ও জাতীয় সংহতি নিয়েই বড় আশংকা। ইসরায়েলে নেতৃত্ব একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে বলে অনেকের সংশয়। কারণ একজনই বারবার ক্ষমতায় আসছেন। অর্থনৈতিক শক্তি নির্ভর করে দেশটির সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন তার ওপর। কিন্তু এখন সেই সম্পর্কে চিড় ধরছে। দেশের মধ্যে জাতীয় সংহতি দিন দিন কমছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট এহুদ বারাকও ২০২২ সালের হিব্রু ভাষার সংবাদপত্র ইয়েদিওথ আহরোনোথকে সাক্ষাত্কারে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন যে ইসরায়েল তার ৮০ বছর পার করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তার মতে, কার্স অব এইটথ ডিকেড বা অষ্টম দশকের অভিশাপ ইসরায়েলের অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারে। এমনকি ২০২২ সালে জুনে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটও বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ৮০ বছর পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
এদিকে অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও পূর্ব বায়তুল মুকাদ্দাস শহরের শত শত অবৈধ বসতিতে থাকা উগ্র ইসরায়েলি অভিবাসীদের ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের ৬৯ শতাংশই মনে করে যে ইসরায়েলের ভবিষ্যত্ অন্ধকার। রাইল হাইয়োম নামের একটি দৈনিক এ সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, শতকরা ৩৩ শতাংশ ইসরায়েলি যুবক নিরাপত্তা না থাকা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সামাজিক বিভাজনের কারণে অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে চলে যেতে চান। সমীক্ষা থেকে আরো জানা যায় যে, ৬৬ শতাংশ অভিবাসী ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনীকে বিশ্বাসই করেন না। ৪৪ শতাংশ ইসরায়েলের ভবিষ্যত দেখেন না।