বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সামরিক শক্তির দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন, শোষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে জাতিকে একটি আদর্শিক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের মহান রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৬ দফা আমাদের জন্য ছিলো ঐতিহাসিক একটি ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য ৬ দফা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।
দফা-১: শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।
দফা-২: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে— দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। বাকি সব বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
দফা-৩: মুদ্রা বা অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দুটির যেকোনো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে—
ক. সারাদেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে; অথবা
খ. বর্তমান নিয়মে সারাদেশের জন্যে কেবল একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
দফা-৪: রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলোর কর বা শুল্ক নির্ধারণের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো ধরনের কর নির্ধারণের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সব ধরনের করের শতকরা একই হারে আদায় করা অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
দফা-৫: বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
ক. ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে;
খ. বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলোর এখতিয়ারে থাকবে;
গ. কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোনো হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোই মেটাবে;
ঘ. অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোনো ধরনের বাধা-নিষেধ থাকবে না;
ঙ. শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে বিদেশে নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি পাঠানো এবং নিজ স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
দফা-৬: আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে নিজ কর্তৃত্বে আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
এই দাবি সমূহে মূলত বলা হয়েছিলো পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ব্যতিত অন্যান্য সকল ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের কাছে থাকবে। পকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শাসকগোষ্ঠী ৬ দফা দাবিকে গুরুত্ব দেয়নি যা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বন্দুকের মাধ্যমে ৬ দফা প্রতিহতের ঘোষণা দেয়।
আইয়ুব খানের নির্যাতনের পটভূমিতে দ্রুতই ৬ দফা মানুষের সমর্থন পেতে থাকে। মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার ও ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু সারাদেশ ব্যাপী ৬ দফার সমর্থনে সমাবেশ শুরু করেন। ২ মাসের মধ্যে ৮ বার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ঐ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় ও ৯ ই মে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।
বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের ফলে বাঙালিরা ফুঁসে উঠে। ৭ জুন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। হরতালের প্রতিহতের ভার পড়ে তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের উপর। মোনামেয় খানের আদেশে ৭ই জুন আওয়ামী লীগের মিছিলে গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। শ্রমিক নেতা মনু মিয়া সহ ১১ যে সেদিন শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু সেদিনও জেলে। দুপুরের পর তিনি জানতে পারেন দেশের মানুষ ৬ দফার সমর্থনে স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচা’য় ৭জুন সম্পর্কে লিখেছেন : ‘‘১২ টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছেন। তাঁরা ৬-দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তাঁরা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল”।
পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসকেরা নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। কিন্তু বাঙালি জাতি নির্যাতনের মধ্যেও ৬ দফা দাবীতে অটল থাকেন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু ও আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেওয়া হয়। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে পরিচিত। কিন্তু আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানি সরকার সেই মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
৬ দফা মূলত বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলো। ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও সাধারণ নিরস্ত্র জনগণের উপর হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ৬ দফা একই সূত্রে গাঁথা।
সুমনা আক্তার লিলি
সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সদস্য, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ